আন্তর্জাতিক বাণিজ্যবিরোধী শর্তে একমত হয়নি ঢাকা

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যবিরোধী শর্তে একমত হয়নি ঢাকা
শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা বৈঠক
যুক্তরাষ্ট্র অন্য কোনো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে বাংলাদেশকেও তা অনুসরণ করতে হবে। এ ছাড়া চীনের ওপর আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন কিছু শর্তে একমত হতে পারেনি ঢাকা। এ কারণে বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে তিন দিনের বৈঠকে শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি সমঝোতা হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে ১ আগস্টের আগে ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে আরও এক দফা আলোচনা হবে। এদিকে শুল্ক চুক্তির ক্ষেত্রে দরকষাকষির প্রস্তুতিতে বাংলাদেশের ঘাটতি ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিতীয় দফার শুল্ক আলোচনার তৃতীয় ও শেষ দিনের বৈঠক শুক্রবার ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর শনিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এবং ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈঠকে আরও কিছু বিষয়ে দুই দেশ একমত হলেও কয়েকটি বিষয় এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। উভয় পক্ষই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, নিজেদের মধ‍্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় আলোচনা চালু থাকবে। তারপর আবার দুই দেশের প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসবেন। সেই আলোচনা ভার্চুয়ালি এবং সামনাসামনি দুই প্রক্রিয়াতেই হতে পারে। দ্রুত পরবর্তী দফার আলোচনার সেই সময়-তারিখ নির্ধারিত হবে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান ও অতিরিক্ত সচিব ড. নাজনীন চৌধুরীর গতকাল ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে। আলোচনার অগ্রগতি জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার আলোচনা সার্বিকভাবে সফল হয়েছে। মার্কিন প্রস্তাবের ৮০ শতাংশ বিষয়ে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে মতৈক্য হওয়া সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। দ্বিমত কোথায়বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আলোচনায় কিছু স্পর্শকাতর শর্তে বাংলাদেশ একমত হতে পারেনি। যেমন– যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দেশকে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তবে বাংলাদেশকেও তা মেনে চলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে। তাছাড়া যেসব মার্কিন পণ্যকে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে, সেগুলো অন্য কোনো দেশকে না দেওয়ার শর্তও দেয় দেশটি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এসব শর্ত সাংঘর্ষিক হওয়ায় বাংলাদেশ তা মানতে রাজি হয়নি। সূত্র জানায়, ঢাকার পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, বাংলাদেশ সব দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন মেনেই ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চায়। তাই এসব শর্ত মানা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের শুল্কযুদ্ধের অংশ হিসেবে মার্কিন কর্মকর্তারা বাংলাদেশকে শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য চীনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। এসব বিষয়েও মতপার্থক্য দেখা দেয়। মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে প্রবেশের জন্য ৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজনেরও শর্ত রয়েছে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের কাঁচামালের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চীন থেকে আমদানি করে। চীনের এই বাজার কমাতে এ ধরনের শর্ত দেওয়া হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দেশকে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তবে বাংলাদেশকেও তা মেনে চলার মতো শর্ত অযৌক্তিক। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের শুল্কযুদ্ধের অংশ হিসেবেও বাংলাদেশকে বেশ কিছু শর্ত দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ভিয়েতনামও চীন থেকে প্রচুর কাঁচামাল আমদানি করলেও তাদের ওপর এমন শর্ত কেন দেওয়া হলো না কিংবা  শর্ত থাকলেও ভিয়েতনাম কীভাবে সমাধান করল। ভিয়েতনামকে সব মিলিয়ে ২০ শতাংশ শুল্ক দেওয়া লাগবে। অথচ শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন না হলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুল্ক ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দরকষাকষিতে সরকারের প্রস্তুতিতে ঘাটতিড. জাহিদ হোসেন বলেন, গত ২ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। তিন মাসে কিছু কেনাকাটা বাড়ানোসহ শুল্ক কমানোর খণ্ড খণ্ড কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে নীতির সমস্যাগুলো নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। প্রথম দিকে ত্বরিত গতিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও পরে এসব ইস্যুতে ঢিলেমি দেখা গেছে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি করার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিনিধি দলে বছরের পর বছর বাণিজ্য নিয়ে গবেষণা করছে এমন কাউকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। শুধু আমলাদের নিয়ে দরকষাকষির চেষ্টা করা হয়েছে। আগামীতে এ বিষয়গুলোতে সমন্বিত প্রস্তুতি নিতে হবে।  বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও প্রস্তুতির দুর্বলতার কথা স্বীকার করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা না করাকেও দায়ী করেন তারা।