গণতন্ত্র ও পশ্চিমা মূল্যবোধ প্রচারে স্টেট ডিপার্টমেন্টে নতুন বিভাগ

গণতন্ত্র ও পশ্চিমা মূল্যবোধ প্রচারে স্টেট ডিপার্টমেন্টে নতুন বিভাগ

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বহুল প্রত্যাশিত ‘ডিপ-স্টেট’ দূর করার আকাঙ্ক্ষার অংশ হিসেবে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এর প্রথম ধাপে গত শুক্রবার থেকেই শুরু হচ্ছে পররাষ্ট্র সার্ভিসের কর্মী ছাঁটাই। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ বিষয়ক ডেপুটি সেক্রেটারী  মাইকেল রিগাস জানান, পুনর্গঠনের প্রভাবে যেসব কর্মী প্রভাবিত হবেন, তাদের শিগগিরই জানানো হবে। যদিও স্টেট ডিপার্টমেন্টের কেউ প্রকাশ্যে বলেননি ছাঁটাইয়ের প্রথম নোটিশ কবে দেয়া হবে, কিন্তু ডিপার্টমেন্টের অভ্যন্তরীণ ইমেইল সূত্রে জানা গেছে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন শুক্রবার থেকেই শুরু হচ্ছে। এই উদ্যোগ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এজেন্ডার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি খাপ খাওয়াতে তার বহুদিনের লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ। জানা গেছে, ছাঁটাইয়ের তালিকায়  মার্কিন পররাষ্ট্র সার্ভিসের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারাও রয়েছেন—যারা চীন ও রাশিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মুখোমুখি হয়ে মার্কিন স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছেন।  

এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে একটি নতুন ‘আন্ডার সেক্রেটারি ফর ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স’ পদ তৈরি করা হচ্ছে, যা ইতিমধ্যেই সিনেটে পাস হয়েছে। এই পদ নতুনভাবে গঠিত 'ব্যুরো অব ডেমোক্রেসি, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লেবার-এর দেখভাল করবে। এটি ‘পশ্চিমা মূল্যবোধভিত্তিক কূটনীতি’-কে ভিত্তি করে পুনর্গঠিত হবে এবং এর নেতৃত্বে থাকবেন একজন ‘ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন ভ্যালুজ’।

উল্লেখ্য, ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে স্টেট সেক্রেটারি মার্কো রুবিওকে পররাষ্ট্রসেবা পুনর্গঠনের নির্দেশ দেন, যাতে তার পররাষ্ট্রনীতি ‘বিশ্বস্ততার সঙ্গে’ বাস্তবায়িত হয়। ট্রাম্প বারবার ‘ডিপ স্টেট’ দূর করার ঘোষণা দিয়েছেন—যারা তার মতে, প্রশাসনের প্রতি অনুগত নন। সুপ্রিম কোর্ট মঙ্গলবার ট্রাম্প প্রশাসনের ফেডারেল সরকারজুড়ে ব্যাপক ছাঁটাই ও পুনর্গঠনের উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথ সুগম করে দেওয়ার পর এই ছাঁটাই কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।

স্টেট ডিপার্টমেন্ট মে মাসে কংগ্রেসকে জানিয়েছিল, তাদের ১৮,৭৩০ জনের ঘরোয়া কর্মী বাহিনী থেকে সর্বোচ্চ ১,৮৭৩ জনকে ছাঁটাই করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া আরও প্রায় ১,৫৭৫ জন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এই ছাঁটাইয়ের মধ্যে সিভিল সার্ভিস ও ফরেন সার্ভিসের সেই সদস্যরাও থাকবেন, যারা বর্তমানে বিলুপ্ত অথবা পুনর্গঠিত হওয়া অফিসে কাজ করতেন। মে মাসে কংগ্রেসকে আরও  জানানো হয়, এই পুনর্গঠন ৩০০টিরও বেশি অফিস ও ব্যুরোকে প্রভাবিত করবে। 

পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে, ‘নাগরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের’ বিষয়ক শীর্ষ পদ বিলুপ্ত হচ্ছে। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধ ও বৈশ্বিক সংঘাত পর্যবেক্ষণকারী অফিসগুলোকেও বাতিল করা হচ্ছে।  আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দুই দশকের সম্পৃক্ততার ওপর নজরদারির দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু বিভাগ বিলুপ্ত হচ্ছে, যার মধ্যে এমন একটি অফিসও রয়েছে যা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর পক্ষে কাজ করা আফগান নাগরিকদের পুনর্বাসনে কাজ করছিল। একই সঙ্গে তারা শরণার্থী ও অভিবাসনসংক্রান্ত কর্মসূচি এবং মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রসারে সংশ্লিষ্ট নানা উদ্যোগও বাতিল করতে চায়।

গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে কর্মী ছাঁটাই বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রী রুবিও বলেন তিন সপ্তাহ আগেই এই সংস্কার প্রস্তাব সিনেট অনুমোদন দিয়েছে, মাঝখানে আদালতের নির্দেশনার জন্য দেরি হয়েছে। গত মঙ্গলবার আদালতের অনুমতি পাওয়া গেছে, তাই সংস্কার প্রস্তাব এখন বাস্তবায়ন শুরু হলো। রুবিও বলেন, এই ছাঁটাইয়ের মূল উদ্দেশ্যে হলো মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে গতিশীল এবং জাতীয় স্বার্থের সাথে সর্বোচ্চভাবে  সম্পৃক্ত করা। এর আগে গত মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরই স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস বলেছিলেন, ‘যখন কোনো কিছু এত বড় হয়ে যায় যে তা পরিচালনা করা যায় না, অতিরিক্ত আমলাতন্ত্রে জর্জরিত হয়ে পড়ে এবং প্রকল্প বা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়— তখন পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়োজন।’

এদিকে গত সপ্তাহে ১৩০ জনের বেশি সাবেক কূটনীতিক ও সিনিয়র কর্মকর্তারা একটি খোলা চিঠিতে এই পরিকল্পনার সমালোচনা করেন। তারা বলেন, অঞ্চলভিত্তিক অভিজ্ঞতা, ভাষাজ্ঞান ও অনেক বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শত শত অভিজ্ঞ পররাষ্ট্র সার্ভিসের কর্মকর্তাদের এই ছাঁটাই অগ্রহণযোগ্য। তারা বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন ‘মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ’ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক  উদ্যোগগুলো বাতিল করেছে। 

আমেরিকান ফরেন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন গত মাসে স্টেট ডিপার্টমেন্টকে এই ছাঁটাই পরিকল্পনা স্থগিত রাখার আহ্বান জানায়। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি থমাস ইয়াজদগেরদি বলেন, এই সময় ছাঁটাই ‘বিশেষভাবে অপ্রয়োজনীয়’, কারণ ইউক্রেন, গাজা, ইরানের মতো সংকটপূর্ণ অঞ্চলে দক্ষ কূটনৈতিক উপস্থিতি অপরিহার্য। তিনি জানান, ফরেন সার্ভিসের অনন্য কাঠামো—যেমন ব্যক্তিগত পদমর্যাদা ও ‘আপ-অর-আউট’ পদ্ধতি—এই ছাঁটাই পরিকল্পনায় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ইয়াজদগেরদি আরো বলেন, ছাঁটাই শুধু মনোবল নয়, নিয়োগ ও দক্ষ জনবল ধরে রাখার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, ‘এইভাবে ফরেন সার্ভিসে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে জাতীয় স্বার্থ ঝুঁকির মুখে পড়ে— এবং এর মূল্য দিতে হবে সারা বিশ্বের সব আমেরিকানকে।’