রক্তের দাগ মুছে ভূস্বর্গে ফেরা
- ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৩:৪৫

‘যদি কোথাও স্বর্গ থাকে, তবে এটাই সেই জায়গা’– এই পুরোনো ফার্সি পঙ্ক্তিগুলো বারবার উচ্চারিত হয় কাশ্মীরে। অনেকে বলেন, এই কথাগুলো কাশ্মীরের পেহেলগাম উপত্যকার জন্যই লেখা হয়েছিল। উঁচু পাহাড়ে ঘেরা এই ছোট্ট শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে ছলছল করা লিডার নদী। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শীতল পরিবেশ এঁকে দিয়েছে ‘মিনি সুইজারল্যান্ড’ নামে খ্যাতি। বলিউড সিনেমা থেকে শুরু করে সাধারণ পর্যটকের ভিড়ে প্রতিবছরই জমে উঠত পেহেলগাম।
কিন্তু গত ২২ এপ্রিলের এক ভয়ংকর দিন সব বদলে দেয়। পেহেলগাম থেকে সাত কিলোমিটার দূরের বৈসরণ উপত্যকায় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন ২৫ পর্যটক। তাদের সাহায্য করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা যান স্থানীয় এক ঘোড়াচালকও। এ ঘটনা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে উত্তেজনার চূড়ায় পৌঁছে দেয়। দুই দেশ জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধে। যদিও পরে একটি নাজুক যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছেছে দু’পক্ষই।
এদিকে, সন্ত্রাসী হামলার পর পেহেলগামে সময় যেন থেমে গেছে। শোক আর দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে পর্যটননির্ভর জীবিকা আহরণ করা উপত্যকাটির মানুষের। হোটেল-মালিক জাভেদ বুরজা বলেন, ‘এখানকার মানুষ খুব সাধারণ, দরিদ্র; কিন্তু অতিথিপরায়ণ। এত বড় সহিংসতায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। মুখ থুবড়ে পড়েছে ব্যবসা।’ মার্কেটের দোকানি ফয়জ আহমদ বলেন, ‘দিনে অন্তত তিন হাজার পর্যটকবাহী গাড়ি আসত। হোটেল-দোকান থাকত টইটম্বুর। কিন্তু এখন তার কিছুই নেই।’ ফয়েজের কণ্ঠে ছিল বিস্ময়, ‘এতদিন পর্যটকের কোনো ক্ষতি হয়নি, এবার কেন তাদেরই টার্গেট করা হলো?’
কাশ্মীরি হস্তশিল্প বিক্রেতা ৮০ বছর বয়সী নিজার আলী হতাশা নিয়ে বলেন, ‘অনেকেই ঋণ করে দোকান খুলেছে, গাড়ি কিনেছে। এখন সবাই অনিশ্চয়তায় ভুগছে। এই উপত্যকায় কী যে হয়ে গেল…!’
পর্যটকের জন্য এখনও বন্ধ বৈসরণের পথ। কিন্তু স্থানীয়রা চলাচল করছেন ওই পথে। তবে চলতি জুলাই মাসে অমরনাথ যাত্রাকে ঘিরে কিছুটা আশার আলো এসেছে বৈসরণের অর্থনীতিতে। হাজার হাজার তীর্থযাত্রী আসছেন, অনেকেই ঘোড়ায় চড়ে যাত্রা করছেন। ফলে ঘোড়াচালকরা কাজে ফিরতে পেরেছেন। তবে হোটেল ও দোকানিদের ব্যবসা নেই বললেই চলে। কারণ, তীর্থযাত্রীরা কম খরচে ক্যাম্পে থাকেন; কেনাকাটাও তেমন করেন না।
তবু পর্যটকের ফিরে আসার কিছু ভালো খবরও আছে। জুনে কাশ্মীর উপত্যকায় ৪৫ হাজার পর্যটকের মধ্যে ৪০ শতাংশই গেছেন পেহেলগামে। ‘লাভ পেহেলগাম’ সাইনবোর্ডের সামনে এখন আবারও ছবি তুলছেন পর্যটক। হামিদ ও শাবিবা জাফর পরিবার নিয়ে এসেছেন। বললেন, ‘গতবার অনেক ভিড় ছিল, এবার অনেকটাই ফাঁকা। এখানে এসে তো দেখছি সবকিছু শান্ত, সুন্দর।’ হামিদ বলেন, ‘আমার বন্ধুদের বলছি, তোমরাও এসো; এই শান্তি আর সৌন্দর্য আর কোথায় পাবে?’
এ রকম অনেক কণ্ঠেই ফিরে আসছে পুরোনো সেই স্বপ্ন। স্বর্গের মতো পেহেলগাম আবারও আগের রূপে ফিরবে, রক্তের ছাপ মুছে আবারও পর্যটকের মন ভরাবে পাহাড়-নদী-মাঠের সৌন্দর্য– এমনটাই প্রত্যাশা করছেন বৈসরণের খুব সাধারণ, দরিদ্র কিন্তু অতিথিপরায়ণ মানুষ। সূত্র- বিবিসি।