২০২৪ সালের ১৪ জুলাই: আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন
- ১৪ জুলাই ২০২৫, ০৪:৪৭

২০২৪ সালের ১৪ জুলাই ছিল রোববার। চীন সফর শেষে এদিন রাজধানীর গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা করেন। এতে তার চীন সফরের চেয়ে বেশি প্রশ্ন আসে কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে। বিশেষ করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের কয়েকজন সাংবাদিক কোটা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নানা প্রশ্ন করেন। আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীও নিজের ‘ঝাল ঝাড়েন’। একপর্যায়ে তিনি কোটা আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতি-পুতিদের সঙ্গে তুলনা করেন। মুহূর্তেই এ বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে পড়ে। চাপা ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যার পর থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে মাঠে নেমে আসেন। রাত যত গভীর হতে থাকে, চাপা ক্ষোভও তত প্রকাশ্যে আসতে থাকে। একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা হল ছেড়ে বের হন। ছাত্রলীগ প্রতিরোধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পুরো ক্যাম্পাস চলে যায় বিক্ষুব্ধ কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের দখলে। এ সময় তারা স্লোগান দিতে থাকেন, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার-স্বৈরাচার’। ‘চাইতে এলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ প্রভৃতি স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস। আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কোটাবিরোধী আন্দোলন জ্বলে ওঠে আগুনের ফুলকির মতো। সংবাদ সম্মেলনে একজন টিভি সংবাদিক প্রশ্ন না করে তার মতামত তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ভুল বুঝিয়ে যুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি করা হয়েছে। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আরেকটা খুবই ভুল ধারা তৈরি করা হয়েছে যে, কোটা ও মেধা। মনে হতে পারে যারা কোটায় চাকরি করেন, তাদের কোনো মেধা নেই। কিন্তু আবেদন করার ক্ষেত্রে কোটা লাগে না, প্রিলিমিনারিতে কোটা লাগে না। লিখিত পরীক্ষায় কোটা লাগে না। একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে কোটা লাগে। তখন আসলে মেধায় সবাই সমান। তখন আমার সামনে যদি দুইটি অপশন থাকে, দুজনই সমান মেধাবী। একজন যুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও আরেকজন রাজাকারের সন্তান। আমি অবশ্যই যুক্তিযুদ্ধের সন্তানকে চাকরি দেব।’ ওই সংবাদিক এ কথা শেষ না করতেই প্রধানমন্ত্রী জোরের সঙ্গে বলেন, ‘অবশ্যই’। এরপর প্রধানমন্ত্রী থেমে যান। তিনি ওই সংবাদিককে আরও কথা বলার সুযোগ করে দেন। তখন ওই সাংবাদিক আরও বলেন, ‘তবে মেধা ও কোটা দিয়ে খুব সহজে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাচ্ছে। সব মেধাবীর চাকরিতে না নিয়ে কোটাতে নিচ্ছে। আপনাকে (প্রধানমন্ত্রী) খুবই ধন্যবাদ যে, গত ১০-১২ দিন ধরে আন্দোলন হচ্ছে, আপনারা অসীম ধৈর্যের সঙ্গে আন্দোলন মোকাবিলা করছেন। যারা আন্দোলন করছেন, তারা সংক্ষুব্ধ, চাকরি না পেয়ে বঞ্চিত। তাদের ক্ষোভের সঙ্গে আমরা খুবই একমত। তাদের পেছনে কেউ ইন্ধন জুগিয়ে, ভুল বুঝিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি করছে কি না?’ এরপর তিনি আরও কিছু কথা বলেন। তার কথা শেষ হলে প্রধানমন্ত্রী জবাবে কোটা নিয়ে কিছু কথা বলেন। একপর্যায়ে তিনি বলে ওঠেন, ‘যুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এত ক্ষোভ কেন? তার মানে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা মেধাবী না। যত রাজাকারের বাচ্চারা, নাতি-পুতিরা হলো মেধাবী।’ বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এমন মন্তব্য করেন। এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাংবাদিকের প্রশ্ন ও প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য ভাইরাল হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীসহ সচেতন মহল প্রধানমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় নানা ধরনের কার্টুনও প্রকাশ পেতে থাকে। সমালোচনা চলতে থাকে সর্বত্র। এমনকি সরকারি মহলেও এ বক্তব্য সমালোচিত হয়। সন্ধ্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা একত্রিত হতে থাকেন। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ছাত্রলীগও হলে হলে অবস্থান নিয়ে কোটাবিরোধীদের ধাওয়া করে। একপর্যায়ে কোটাবিরোধীরা হল এলাকা ছেড়ে সংগঠিত হয়ে টিএসসিতে সমবেত হয়। শুরু হয় স্লোগান, ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার-রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার-স্বৈরাচার’। ‘চাইতে এলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ প্রভৃতি স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস। বিভিন্ন হল ও আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যোগ দেন। ছাত্রীরাও হল গেটের তালা ভেঙে আন্দোলনে যোগ দেন। সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলন জ্বলে ওঠে। যে আন্দোলন আদালতের মাধ্যমে বা সরকারের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিল, আন্দোলনের তীব্রতাও কমে আসছিল; কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ওই মন্তব্যে আন্দোলন আবার দানা বেঁধে ওঠে। ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এটিই ছিল কোটাবিরোধী আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। এরপর থেকে সরকার ও আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগও দমন-পীড়নে নামে। ছাত্ররাও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, যা ধীরে ধীরে তীব্র হতে থাকে। এদিকে এদিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন। গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার পর এ আলটিমেটাম দেন তারা। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিতে পুলিশকে আরও ২৪ ঘণ্টা সময় দেন তারা। এদিকে শিক্ষার্থীদের পদযাত্রা ঠেকাতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড দেয় পুলিশ। একের পর এক ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবন অভিমুখে এগিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও পদযাত্রা করে নিজ নিজ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেন। পদযাত্রার উদ্দেশে বেলা ১১টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, ঢাকা কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট মিছিল নিয়ে জড়ো হতে শুরু করেন। দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে তারা পদযাত্রা শুরু করেন। হলপাড়া, ভিসি চত্বর, টিএসসি, শাহবাগ হয়ে পদযাত্রাটি মৎস্য ভবন পৌঁছায়। এরপর প্রেস ক্লাবের সামনের সড়ক দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ হাইকোর্টের মাজারসংলগ্ন রোড দিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করে। পরে শিক্ষার্থীদের পদযাত্রা ওই রোড অতিক্রম করে শিক্ষা ভবনের সামনে পৌঁছলে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে গতিরোধ করার চেষ্টা করে। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে শিক্ষার্থীরা ব্যারিকেড ভেঙে সামনের দিকে অগ্রসর হন। এরপর পদযাত্রা নিয়ে সচিবালয়ের কাছে পৌঁছে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। সচিবালয়ের গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে পৌঁছালে পুলিশ আবার তাদের থামানোর চেষ্টা করে। সামনে এগোতে না পেরে সেখানেই বসে পড়েন আন্দোলনকারীরা। একপর্যায়ে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটের দিকে জিরো পয়েন্টের ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনের দিকে রওয়ানা হন শিক্ষার্থীরা। এ সময় রাস্তা ব্লক এবং বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজারো শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। বেলা আড়াইটার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফরমের ১২ জনের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে যায়। তাদের মধ্যে ছিলেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ, মো. মাহিন, আব্দুল কাদের, আব্দুল হান্নান মাসউদ, আরিফ সোহেল, আশিক আহমেদ, নিদ্রা ও সুমাইয়া আখতার এবং সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম ও রশিদুল ইসলাম রিফাত। বিকাল ৩টার দিকে তারা বঙ্গভবন থেকে বের হন। স্মারকলিপিতে বলা হয়, ছাত্রসমাজের শেষ আশ্রয়স্থল হিসাবে আপনার কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি, জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করে বাধিত করবেন। আমাদের কারণে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হোক, তা আমরা কখনোই চাই না। আমরা দ্রুতই পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে চাই। ছাত্রসমাজ আশা রাখে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করতে উদ্যোগ গ্রহণ করে বাধিত করবেন। স্মারকলিপি দিয়ে বের হয়ে গুলিস্তানের পাতাল মার্কেট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে তিনি বলেন, একদফা দাবিতে আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অধিবেশন ডাকার দাবি জানিয়েছি। আমরা এ দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে চাই। তিনি আরও বলেন, আজ আমাদের থামানো যায়নি। আমরা চাইছি না কঠোর কর্মসূচিতে যেতে। আমরা চাই দ্রুত দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হোক। ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করা হবে। এরপর আমরা সে অনুযায়ী পরবর্তী কর্মসূচি গ্রহণ করব। এদিন দুপুর ১টায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবদুল মালেকের কাছে স্মারকলিপি জমা দেয় শিক্ষার্থীদের ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল। এর আগে বেলা ১১টায় নগরের ষোলশহর স্টেশনে সমবেত হন বিশ্ববিদ্যালয়সহ জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে পদযাত্রা করে দুই নম্বর গেট, জিইসি, কাজীর দেউড়ি, লাভলেন হয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যান তারা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা বিকাল ৩টায় ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেন। এর আগে বেলা ১১টায় মুক্তমঞ্চের সামনে জড়ো হয়ে পদযাত্রা করেন তারা। এছাড়া আনন্দ মোহন সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা আলাদাভাবে পদযাত্রা করে স্মারকলিপি দিয়েছেন। সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, বরিশাল সিটি কলেজ, পলিটেকনিক কলেজ ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষার্থীরা পৃথক মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে স্মারকলিপি জমা দেন।