‘জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য’ শীর্ষক সংলাপ
জাতীয় স্বার্থে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান
- ১৫ জুলাই ২০২৫, ১০:০৬

দলমত নির্বিশেষে জাতীয় স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটা সংসদ গঠন করে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগেই যৌক্তিক সংস্কার হতে হবে। জুলাই বিপ্লবের যে আকাঙ্ক্ষা রয়েছে তা যেন নস্যাৎ না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
গত ৬ জুলাই রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য’ শীর্ষক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (এফএসডিএস) এর আয়োজন করে।
সংলাপে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘গণতন্ত্রকে আমরা ঠিকমতো চর্চা করতে পারিনি, বরং পদে পদে বাধার মুখে পড়েছি। এ জায়গায়গুলোয় আমাদের একমত হতে হবে। এর পাশাপাশি চলমান আলোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়েই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্মাণ করার জন্য সঠিক পথ খুঁজে পাওয়ার জায়গায় আমরা পৌঁছব। যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে পারলে জাতীয় নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে পারব। নিরাপত্তার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়কে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হবে এবং নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের অধিকার অর্জিত হবে। আপনারা সেই তিতুমীরের সময়টার কথা বলেন, সেই সময়ও তারা দেশের স্বার্থে কঠিন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। তাহলে আমরা এখন কেন পারব না? আসুন আমরা সবকিছু ভুলে গিয়ে দেশের স্বার্থে একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করি।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে একটি নির্বাচিত সরকার। যার জন্য আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জামায়াতের ইসলামীর কোনো ধরনের আপত্তি নেই। শুরুতেই আমরা ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছিলাম। সুতরাং ফেব্রুয়ারি এর মধ্যেই পড়ে। কিন্তু যেনতেন কোনো নির্বাচন আমরা চাই না। যেনতেন নির্বাচন চাই না মানে আমরা নির্বাচন চাই না—এ বিষয়টা না কিন্তু। ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে এবং সন্দেহ তৈরি করা হচ্ছে। আর যেনতেন ইলেকশন যদি কেউ চান, আমরা তাদেরও চাই না। এছাড়া এখন আমাদের বিচার ও সংস্কার নিয়ে কাজ করার সুযোগ এসেছে। এ সুযোগকে সবারই আন্তরিকভাবে কাজে লাগানো উচিত বলে আমরা মনে করি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘গত ১৫-১৬ বছর বাংলাদেশের মানুষ মালিকানা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য যুদ্ধ করেছে। এ মালিকানা ফিরিয়ে দেয়ার একমাত্র পন্থাই হলো জনগণের হাতে ব্যালট পেপার তুলে দেয়া। এর মাধ্যমেই সে তার মত প্রকাশ করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের কাছে যাওয়া এবং তার ম্যান্ডেট গ্রহণ করা। সেই ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদে আসা। সেটি না করে অনেকেই অনৈক্যের কথা বলছেন। আমি কোনো অনৈক্য দেখছি না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ঐকমত্যে পৌঁছতে বর্তমান সরকার চেষ্টা করছে। যার জন্য কমিশন হয়েছে। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করেছেন। জাতীয় ঐক্যের একটি বিষয় হলো আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে ঐক্য। এতে কেউ দ্বিমত করে বলে আমি বিশ্বাস করি না। এছাড়া জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্থায়ী নির্বাচন ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। এর পাশাপাশি বৈষম্যমুক্ত অর্থনীতি, বেকার সমস্যা সমাধান, শিক্ষাকে কর্মমুখী করা, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ছাড়া ঐকমত্য হবে না।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘১৫-১৬ বছর ধরে আমরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। সুতরাং আমাদের অবশ্যই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়া দরকার। নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য আমাদের কিছু পদক্ষেপ নেয়া দরকার। শুধু নির্বাচনই নয়, একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করা দরকার। বিদ্যমান প্রক্রিয়া, আইনি কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোই শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচার করেছে। সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে দ্রুত স্বৈরাচারে পরিণত হয়ে তিনি দানবে পরিণত হয়েছিলেন। অর্থাৎ আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়েছে। এগুলোর সংস্কার করা দরকার।’
সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) এম নুরুদ্দিন খান বলেন, ‘১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সেনাপ্রধান থাকাকালে খালেদা জিয়াকে অত্যন্ত নিকট থেকে দেখেছি। উনার ধৈর্য, দেশপ্রেম, জাতীয় স্পিরিট, সহনশীলতা ও ত্যাগ অতুলনীয়। এমন একজন গার্জিয়ানকে পেয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত ভাগ্যবান। তার দল বিএনপির প্রতি আমার একটি অনুরোধ থাকবে, তিনি যেসব অত্যাচার সহ্য করেছেন, সহনশীলতা দেখিয়েছেন, বিএনপি একটি বড় দল হয়ে যেন সেই সব নমুনা আমাদের সামনে আবারো তুলে ধরতে পারেন। আজকে দলটি বহু সমস্যায় ভুগছে। কেউ কারো কথা শুনছে না। দলটিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্যও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে আমার অনুরোধ রইল।’
রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান উত্তম মজুমদার বলেন, ‘নিরাপত্তা ও ঐক্য কাদের জন্য? আমি মনে করি নিরাপত্তা ও ঐক্য হতে হবে মানুষের কল্যাণের জন্য। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলিম সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দেশের অর্থনীতি ও মানুষের কথা চিন্তা করে আমাদের সব দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে ঐক্য হতে হবে। মনে রাখতে হবে মানবসেবাই হলো সবচেয়ে বড় ঐক্য ও নির্বাচন।’
দৈনিক বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকেই নানান সময় একটি কার্যকর রাষ্ট্র্ (ওয়েল ফাংশনিং স্টেট) গঠনের সুযোগ এসেছে, কিন্তু আমরা সেটি পারিনি। এবারো সেই প্রশ্নের মধ্যেই আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। কার্যকর রাষ্ট্র গঠনের পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা এবং জাতীয় ঐক্যের জন্য মুক্ত গণমাধ্যমও জরুরি। সম্প্রতি ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেলড দেখিয়েছে প্যালেস্টাইনে গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা হামাস ও ইসরায়েলের প্রকাশিত সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি। জাতীয় নিরাপত্তা কিংবা ঐক্যসহ অন্যান্য বিষয়ে আমাদের এমনই একটি মুক্ত গণমাধ্যম খুব প্রয়োজন। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী এ সময়ে একটি শক্তিশালী এবং খুব ভালোভাবে কার্যকর একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলার একটি সুযোগ এবারো এসেছে।’
আয়োজক সংস্থার চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবরের সভাপতিত্বে সংলাপে আরো অংশ নেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার, আলোকচিত্রী সাংবাদিক শহিদুল আলম, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী প্রমুখ।