সার্বভৌমত্বের নিক্তিতে ট্রাম্প-শুল্ক তোলা সঠিক হবে না

সার্বভৌমত্বের নিক্তিতে ট্রাম্প-শুল্ক তোলা সঠিক হবে না

মিটফোর্ডের ঘটনা ভাইরাল না হলে পরদিন শুক্রবার বিভিন্ন মসজিদ থেকে ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন কার্যালয় খোলার প্রতিবাদে মিছিল সমাবেশ বের হতো। মিটফোর্ডের ঘটনাটি ঘটেছিল বুধবার, বৃহস্পতিবার রাতে ভিডিও ভাইরাল হয়। শুক্রবার সেই মিছিল আর বের হয়নি। রাত থেকেই শুরু হয়ে যায় বিএনপি'র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল। শুক্রবার তা আরো বৃদ্ধি পায়। ফলে ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় খোলার প্রতিবাদ জানানোর অবকাশ আর হয়নি কারো। ইস্যুটি ডাইভার্ট হয়ে যায়। মানুষ কেবল মঞ্চের অভিনেতাদের দেখে, গ্রিন রুমের কুশীলবদের খবর কেউ রাখে না। দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, সরকার আমেরিকাকে খুশি করতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে জাতিসংঘ কার্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। দেশের ইসলামপন্থী সকল সংগঠন এই কার্যালয় চালুর বিরোধিতা করেছে। মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। প্রতিবাদকারীদের দাবি, জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকার মানদন্ডের বেশ কিছু ধারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম ও দেশীয় মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু সরকার এই আপত্তি অগ্রাহ্য করে উপদেষ্টা পরিষদে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় স্থাপনের খসড়া প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।

এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে প্রথমে একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি চাচ্ছে, যেখানে তাদের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। ফাওজুল কবির খান আরও বলেন, 'আমেরিকার কিছু কৌশলগত বিষয়ে রয়েছে। তার মধ্যে নিরাপত্তা ও অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত।' গত ৯ জুলাই দৈনিক ইনকিলাব অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে আমি বলেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উপর যে শুল্ক আরোপ করেছে এটা শুধু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়। এর সাথে ভূ-রাজনীতি জড়িত। কেবল যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বৃদ্ধি করে ট্রেড ব্যালেন্স তৈরি করলেই এই শুল্ক আরোপ প্রত্যাহার করা যাবে না। বরং যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক ম্যাপিংয়ে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়া মুক্তি নেই। ‌ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বিশ্বকে দেখে বা দেখতে চায়, যুক্তরাষ্ট্রের যারা শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী, তাদের যারা মিত্র- সেভাবেই যদি আমরা আমাদের বৈশ্বিক নীতি এডজাস্ট করতে পারি, তাহলেই এখান থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কী সেটা পারবে? এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী চায়না। বাংলাদেশের পক্ষে কি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাল মিলিয়ে চায়নার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া সম্ভব? আমাদের শিল্প-বাণিজ্যের প্রধান কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির সরবরাহকারী চায়না। সস্তা পণ্যের গ্রাহক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে চায়না কেই প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে বেছে নিতে হয়। এর বাইরে গেলে আমাদের ডবল বা তিনগুণ দামে পশ্চিমা পণ্য হজম করতে হবে। আমাদের জাতীয় প্রতিরক্ষা ও উন্নয়নের প্রধান অংশীদারও চায়না। চাইনিজ আমদানি পণ্য বা কাঁচামালের উপর শুল্ক আরোপ করলে আমাদের রপ্তানি পণ্যের যে মূল্য দাঁড়াবে তা যুক্তরাষ্ট্রের ছাড় করা শুল্ক হার দিয়ে ব্যালেন্স করা যাবে?

মানবিক করিডরের ব্যাপারে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এর কথা বললেও বিএনপির অবস্থান ছিল একেবারে স্পষ্ট। বিএনপি মহাসচিব সরাসরি বলেছিলেন, এই সুবিধা দেয়া হলে বাংলাদেশ গাজায় পরিণত হবে। বিএনপি'র এক্টিং চেয়ারপার্সন তারেক রহমানও এ ব্যাপারে অত্যন্ত সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছিলেন। আমি সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম বিএনপির ওপর একটা বড় আঘাত আসতে চলেছে। যদিও বিএনপি'র এই অবস্থান ছিল প্রকৃতপক্ষেই শতভাগ দেশপ্রেমিক চিন্তার সঠিক অবস্থান। কিন্তু এই অবস্থান পশ্চিমাদেশগুলোর বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দোপ্যাসিফিক পলিসি, বার্মা এক্ট ও কনটেন্ট চায়না নীতির সরাসরি বিপক্ষে। সাম্প্রতিক সময়ে চায়নার সাথে বিএনপির ঘনিষ্ঠতাও তাদের নজর এড়িয়ে যাবার কথা নয়। ফলে বিএনপি'র এই অবস্থান যখন তাদের দীর্ঘদিনের লক্ষ-বাস্তবায়নের পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ প্লান এ যখন ব্যর্থ হয়েছে, তখন প্লান বি সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে বিএনপিকে এমনভাবে কোণঠাসা করা যাতে বন্দর, করিডোর প্রভৃতি ইস্যুতে পশ্চিমা পরিকল্পনায় যেন তারা বাধা হতে না পারে। আর রাষ্ট্রকে বাধ্য করার জন্য এই শুল্ক আরোপের চাপ সৃষ্টি করা। যাতে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থানকারী মার্কিন নাগরিক, পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট কার্ডধারী ও পেয়ারে মার্কিন নাগরিকদের বলতে সুবিধা হয় যে, এই এই সুবিধা না দিলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। কাজেই দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে হলে ওইসব সুবিধা দেয়া ছাড়া আর কোন অপশন নেই।

ডেমোক্রেট ফ্রেন্ড ইউনুস রিপাবলিকান ট্রাম্পের সাথে সম্পর্ক করতে ট্রাম্পের সদ্য সাবেক অতি ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা এলন মস্কের স্টার লিংক অতি দ্রুত, এমনকি মনিটরিং হীন অবস্থায় বাংলাদেশে চালু করে দেয়। কিন্তু ট্রাম্প ও মস্ক সংসার দীর্ঘস্থায়ী না পাওয়ায় এর ফায়দা বাংলাদেশ না পেলেও স্টার লিংকের আপদ বাংলাদেশকে বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এমনকি কারো সাথে আলোচনা ছাড়াই এবং দেশবাসীর বিরোধীতা সত্বেও সরকার বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর পার্বত্য চট্টগ্রামের এই স্টার লিংক সংযোগ চালুর উদ্যোগ নিয়েছে।

ট্রাম্প যখন বাংলাদেশের উপর ৩৭% শুল্ক আরোপ করেন তখন মস্কের সাথে তার বন্ধুত্ব বেশ ঘনিষ্ট ছিল। কিন্তু তিনি এতে কোন ভূমিকা রাখেননি। যুক্তরাষ্ট্র তার রাষ্ট্রীয় পলিসির সাথে ব্যক্তিগত বাণিজ্যকে কনসিডার করে না। অর্থাৎ মস্ককে বাণিজ্য সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশের উপর আরোপিত শুল্ক হ্রাস করার পরিকল্পনাটি ভুল ছিল। এরপর প্রায় ১ মাস ধরে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী অ্যাডভাইজার রজার রহমানকে ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রীয় খরচে দুতিয়ালি করে ফিরেছেন।

এক মহাসাগর রক্তের বিনিময়ে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে গঠিত সরকারে একগাদা মার্কিন নাগরিক, মার্কিন পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট কার্ডধারী নাগরিক ও পেয়ারে মার্কিন নাগরিককে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসানো হলো। এরা গত ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে সেদেশেই বসবাস করছে স্থায়ীভাবে। বাংলাদেশের আলো, হাওয়ায় বেড়ে উঠে, জনগণের কষ্টের টাকায় লেখাপড়া শিখে দেশের খেদমতের চেয়ে মার্কিন সরকারের খেদমতের মাধ্যমে নিজেদের সুখ ও স্বাচ্ছন্দময় জীবন তারা বেছে নিয়েছে। দেশের মানুষের দুঃখ- কষ্ট, সংগ্রামে তাদের কোন অবদান নেই অন্তত ২-৩ দশক। এমনকি এই ৩৬ জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও তাদের শরীর থেকে এক ফোঁটা ঘাম বের হয়নি। শীতের পাখির মত পুরোটাই উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। তবুও দেশের মানুষ খুব বেশি প্রশ্ন করেনি। হয়তো মিশন শেষে আশরাফ ঘানি, হামিদ কারজাই, আহমদ চ্যালেবিদের মতো পুনরায় উড়ে যাবেন আপন ঠিকানায়। সাথে নিয়ে যাবেন পরবর্তী চার-পাঁচ প্রজন্মের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের মূলধন।

প্রশ্ন হল, এত মার্কিনী ও পেয়ারে মার্কিনী বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার পরেও ৩৫% শুল্ক আরোপ কেন হলো? কেন আপনারা ঠেকাতে পারলেন না? উপরোন্ত নিয়ন্ত্রণহীনভাবে স্টারলিংক দিলেন, মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় দিলেন- তারপরেও কেন ৩৫% শুল্ক থাকবে? আপনাদের বসিয়ে কী লাভ হল জাতির? আমেরিকার ৩৫% শুল্কই যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে আপনাদের কেন মানবো? কেন ট্যাক্সের টাকা দিয়ে জনগণ আপনাদের ভিআইপি মর্যাদায় রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও বেতন দিয়ে ক্ষমতার চেয়ারে বসিয়ে রাখবে?

বর্তমানে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে সারা দেশব্যাপী যে রাজনৈতিক সংগঠন সক্রিয় রয়েছে তা মূলত বিএনপি। জামাত পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে শক্তিশালী হওয়ার পরেও দেশের সব ইউনিয়ন, সব উপজেলা, সকল জেলায় তাদের ডমিনেট করার ক্ষমতা নেই। বরং অল্প কিছু জেলা, অল্প কিছু উপজেলা এবং অল্প কিছু ইউনিয়নেই তাদের ডমিনেট করার ক্ষমতা রয়েছে। এটাই বাস্তবতা। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এই অবস্থায় বিএনপিকে কোণঠাসা করা গেলে, নানা ইস্যুতে বিএনপিকে চেপে ধরতে পারলে দেশের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত রাজনৈতিক কাঠামোতে যে শূন্যস্থান তৈরি হবে সেটা পূরণের ক্ষমতা জামাতের নেই। বিএনপিকে আটকে রেখে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ডমিনেট করার মত রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কাঠামো এখনো জামায়াতের বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের তৈরি হয়নি। ফলে এই শূন্যতা বা এই শূন্যস্থান অটোমেটিক্যালি আওয়ামীলীগই পূরণ করবে। জামায়াত জোরেশোরে স্থানীয় সরকারের দাবি করছে। যেহেতু দলীয় ব্যানারে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে না, সে কারণে এই মুহূর্তে যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয় বাংলাদেশের কতগুলো ইউনিয়ন পরিষদ উপজেলা পরিষদ বা পৌর কাউন্সিলে জামায়াতের জয়লাভ করা সম্ভাবনা রয়েছে? সেই তুলনায় স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়িয়ে সাংগঠনিক কাঠামো ও ব্যক্তি জনপ্রিয়তার উপর ভর করে আওয়ামীলীগ কয়েক হাজার ইউনিয়ন পরিষদ উপজেলা পরিষদ ও পৌর কাউন্সিলে চেয়ারম্যান মেয়র ও ভাইস চেয়ারম্যান কাউন্সিলর পদে জয়লাভ করবে। মূলত জামাতের এই দাবির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকেই পুনর্বাসিত করা হবে।

কারণ বিতর্কিত ও ক্ষয়িষ্ণু হলেও এখনো তৃণমূল পর্যন্ত একমাত্র আওয়ামী লীগেরই সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে এবং ডমিনেট করার ক্ষমতা রয়েছে। এটাও বাস্তবতা। কাজেই বিএনপিকে চেপে ধরে, বিতর্কিত করে জামাতের কোন লাভ নেই। পিনাকী ভট্টাচার্যও সম্প্রতি এই ইঙ্গিতই দিয়েছেন। ফলে বিএনপি আটকে গেলে এই শূন্যস্থানে আওয়ামী লীগ উঠে আসবে। কিন্তু দেশে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মানুষের এখন যে ধারণা সেটা গ্রহণ করাও তাদের জন্য কঠিন। ফলে নতুন করে একটা সংঘাত তৈরি হবে। এই সংঘাতে বাংলাদেশ একটা গৃহযুদ্ধের পথে ধাবিত হতে পারে। এবং সেটা পশ্চিমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ সুগম করে দেবে।

কিন্তু যদি আওয়ামী লীগও ফিরে আসতে না পারে, এবং বিএনপিও আটকে যায় তাহলে কী হবে? যদি এমনটা কল্পনা করি যে, তৃতীয় শক্তি হিসেবে ইসলামপন্থী দলগুলো সেই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে এলো- তাহলে কী হতে পারে? প্রথমত আকিদাগতভাবে ইসলামপন্থী দলগুলোর এক হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সেকুলার রাজনীতির পতন ও মধ্যপন্থী রাজনীতি বিতর্কিত করার ফলে দেশের মধ্যে চরমপন্থার উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ‌ সম্প্রতি ওয়াজ নসিহত নিয়ে দ্বিমত হওয়ায় যে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে এটা তার সবচেয়ে ছোট উদাহরণ। তাছাড়া ইসলামের শত্রুরাও চাইবে ১৬ কোটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে চরমপন্থা উসকে দিয়ে বাংলাদেশকে ট্যাগিং করতে। যেভাবে আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় তারা করেছে। প্রথমে নিজেরাই চরমপন্থা উৎপাদন করেছে, তারপর একপক্ষকে সমর্থন এবং আরেক পক্ষকে নিয়ন্ত্রণের নামে দেশে গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করেছে, নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং একসময় সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। তারপর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে নতুন পরিকল্পনা পয়দা করেছে।

বৈশ্বিক রাজনীতির বর্তমান মেরুকরণ অনুযায়ী মিয়ানমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। কেবলমাত্র ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণে এই দেশটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, এই দেশে রয়েছে অত্যন্ত দুর্লভ খনিজ পদার্থের বিশাল ভান্ডার। এই ভান্ডারের ফায়দা একমাত্র লুটছে চায়না। মিয়ানমারের ভেতরে চায়না ছাড়াও ভারতের শক্তিশালী অবস্থান থাকা সত্ত্বেও সক্ষমতাগত কারণে ভারত এখান থেকে কোন সুবিধা গ্রহণ করতে পারছে না। কেননা এই ধরনের দুর্লভ খনিজ আহরণ ও বিশুদ্ধকরণের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা ভারতের নেই। ভারত মিয়ানমারের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান কাজে লাগিয়ে সিটুয়েতে ডিপ সি পোর্ট তৈরি করেছে। এটি তাকে সংকীর্ণ চিকেন নেক এড়িয়ে এবং বাংলাদেশকে থোড়াই কেয়ার করে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। অন্যদিকে চায়না দুইটি ডিপ সি পোর্ট তৈরি করে বহুমাত্রিক সংযোগের মাধ্যমে মূল ভূখণ্ডকে সংযুক্ত করেছে। রাশিয়ার নেতৃত্বে সেখানে আরেকটি ডিপ সি পোর্ট তৈরির কার্যক্রম চলছে। এহেন পরিস্থিতিতে বিশ্বের প্রধান মোড়ল ও একমাত্র মোড়ল দাবিদার মার্কিনীদের অনুপস্থিতি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় তাদের কাছে। বিশেষ করে মিয়ানমার হয়ে চায়নার বঙ্গোপসাগরে সরাসরি সংযোগ একেবারেই অপছন্দ মার্কিনিদের। ফলে তারা সেখানে ঢুকতে চায়। সেজন্যই বাংলাদেশ দরকার তাদের। যদি বাংলাদেশ হয়ে মার্কিনীরা মিয়ানমারে ঢুকতে পারে তাহলে বাংলাদেশে তাদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। এবং এটাকে তারা ভারতের হাতে ছেড়ে দেবে, যেভাবে ট্রাম্প কিছুদিন আগে মোদিকে ইঙ্গিত করে বলেছিল।

এই বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় চায়না হাত গুটিয়ে বসে নেই। বিশেষ করে আরাকান আর্মি তাদের আধিপত্য বিস্তারে ভারতীয় সমুদ্র বন্দর শহর সিটুয়ে রেখে চাইনিজ সমুদ্র বন্দর শহর কিয়াকফিউকে বেছে নেয়ার পর মিয়ানমারে চায়নার স্বার্থ ও বিনিয়োগ চরমভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই মনে করেন, চায়না সেখানে ভাড়াটিয়া সেনাদের মাধ্যমে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সুবিধা ব্যবহার করে লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে আরাকান আর্মিকে যদি পশ্চিমারা রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে পারে এবং একটি নির্ভরশীল স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে তাহলে মিয়ানমার হয়ে উঠবে বৈশ্বিক রাজনীতির এক মল্ল ক্ষেত্র। বাংলাদেশ এখানে একটি বাফার স্টেট মাত্র। এর বেশি কিছু নয়।

মার্কিনীরা মূলত শুল্ক আরোপের নামে বাংলাদেশকে যেভাবে তাদের পাশে চাইছে সেটা চায়না ও ভারতের পছন্দনীয় হবে না। কেননা, কেবল রাখাইন নয়, এই অঞ্চলে ক্রিশ্চিয়ানা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, তাতে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ভারতের উত্তর-পূর্বের কিছু রাজ্য জড়িত। বাংলাদেশের সাথে ভারত ও চায়নার যে বহুমাত্রিক ও গভীর সম্পর্ক এবং স্বার্থ জড়িত, যোগাযোগ ও অবস্থানগত কারণে এখানে উক্ত দেশ দুটির যে সুবিধা, সেটা সাত সমুদ্দুর ও তের নদীর ওপারের দেশ আমেরিকার পক্ষে অতিক্রম করা কখনোই সম্ভব নয়। একই কারণে আমাদের পক্ষেও উক্ত দেশ দুটিকে উপেক্ষা করে মার্কিনীদের কোলে ওঠা সম্ভব নয়।

এই বাস্তবতায় আমাদেরকে মার্কিনী এই শুল্কের সাথেই বাঁচতে হবে। বাঁচা শিখতে হবে। সৎ ও দেশপ্রেমিক দৃষ্টিতে চেষ্টা করলে এই পরিস্থিতি আমরা উতরে উঠতে পারি। কিন্তু শর্ত মেনে মার্কিনীদের খপ্পরে পড়লে আর কখনোই উঠে দাঁড়াতে পারবো না। এটাও সত্য যে, মার্কিনীদের পক্ষেও এত দ্রুত সস্তা শ্রমের প্রশিক্ষিত জনগণ ও অবকাঠামো তৈরি করা সম্ভব নয়।

একটা রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কেবলমাত্র অর্থনৈতিক নিক্তিতে মাপা হয় না। তাহলে বিশ্বের বহু দেশ যুগের পর যুগ মার্কিনী নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েও মাথা নত না করে টিকে থাকতো না। জাতীয় স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় লক্ষ্য, চেতনা ও মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেও তারা যুগের পর যুগ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর শর্তের কাছে নতি স্বীকার করেনি। নর্থ কোরিয়া ও ইরান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমরা যদি স্বাধীনতার জন্য ৩০ লক্ষ প্রাণ বিসর্জন দিতে পারি, তাহলে সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যেও আমাদের যেকোন ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। উদ্দেশ্য যদি সৎ হয়, দেশপ্রেমিক হয়, এই দেশের মানুষ কখনোই সেই ত্যাগ স্বীকারে পিছপা হয়নি।

ক্রেডিট: মেহেদী হাসান পলাশ