মতামত

রাজনীতির পথে যে নবীন, পদে পদে তার ভুল ধরে প্রবীণের কোনো সুকৃতি তৈরি হয় না

রাজনীতির পথে যে নবীন, পদে পদে তার ভুল ধরে প্রবীণের কোনো সুকৃতি তৈরি হয় না
মাসকাওয়াথ আহসান- সংগৃহীত ছবি

জুলাই বিপ্লবে অনলাইনে সক্রিয় ছিলেন; অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর গুরুত্বপূর্ণ কোনো সরকারি পদ পাননি; এমন লোকেরা জুলাই বিপ্লবী ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়েছে।

পতিত আওয়ামী লীগ বা প্রচ্ছন্ন আকাশি বাম নতুন বন্দোবস্তের শত্রু; এটা সবাই জানে; সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের সহযোদ্ধা শত্রুতা করলে তা ঘরের বন্ধু বিভীষণ হয়ে পড়ে।

পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও কোনো ভূগোলে এমন হয়নি যে, বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পরের দিন সকাল থেকে কোনো সমাজ স্বর্গ হয়ে উঠেছে। এমন জাদুকরি সমাধান কারো হাতে থাকে না। অথচ পৃথিবীর রাজনীতি ও ইতহাসের মনোযোগী পাঠক বলে দাবি করা লোকেদের আমরা দেখি; অতিদ্রুত হাসিনার ফ্যাসিজমের সঙ্গে ইউনুসের শাসনের ইকুয়ালাইজিং করে, দেশটা শেষ হয়ে গেলো রব তুলতে।

আসলে শেষ হয়েছে তাদের জীবন, যারা নিজের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে জীবন নির্বাহ না করে হাসিনার পাওয়ার করিডোরের অংশীজন হয়ে এফলুয়েন্ট হতে চেয়েছেন, ক্ষমতাধর হতে চেয়েছেন। হতাশ হয়েছেন তারা, যারা হাসিনা পতনের জন্য লড়াই করে ৫ অগাস্ট পরবর্তী পাওয়ার করিডোরের অংশীজন হতে চেয়েছিলেন।

রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির প্রতি অনুরোধ, ৫ অগাস্টের পর যারা বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে ইউনুস বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে; জুলাই বিপ্লবী তরুণদের ছিদ্রান্বেষণ করছে; তাদেরকে বেশি আশা দেবেন না। এতো সরকারি পদ-পদবী, আনুকূল্য তো নেই; যা দিয়ে এদের সবাইকে তুষ্ট করতে পারবেন। বিএনপির পাওয়ার করিডোরে অংশীজন হতে না পারলেই দেখবেন; ঘরের বন্ধু বিভীষণ হয়ে উঠেছেন।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের পর দলটির শুভাকাঙ্ক্ষীদের পদ-পদবী, আনুকূল্য দিতে দিতে; তার দুঃসময়ের বন্ধুদের অবহেলা করেছিল। কোত্থেকে খোকন সোনা, আরাফাত সোনা জুটে গিয়েছিলো তাদের। যারা দলীয় রাজনীতির অভিজ্ঞতা না থাকায়; জনবিনাশী গ্যাং পাকিয়ে ফ্যাসিজমের বৃক্ষের পরিচর্যা করেছিল।

রাজনীতিতে কাজলরেখা উপকথার কাজল রেখাকেই খুঁজে বের করতে হয়; দলের দুঃসময়ে যে একটা একটা করে সূঁচ তুলেছে দলের শরীর থেকে; তাকে বাঁচিয়ে তুলতে জীবন উৎসর্গ করেছে। দলের সুসময় কাছে এলে কাঁকন দাসী এসে চোখের সূচ তুলে সমস্ত কৃতিত্ব নেবার চেষ্টা করে। নব্বই পরবর্তী দ্বিদলীয় রাজনীতি ক্রমশ সুযোগ সন্ধানী কাঁকন দাসীদের রাজনীতি হয়ে উঠেছে।

আওয়ামী লীগের যে বাচাল বুদ্ধিবৃত্তি ও আউটডেটেড কালচারাল উইং; তা পদ-পদক-প্লট নিয়েছে ঠিকই; কিন্তু উপকারের চেয়ে বেশি ক্ষতি বেশি করে বিভাজনের দোকান খুলে বিদ্বেষের সওদা করে।

অনেক ঝড় ঝাপটার মাঝেও বিএনপির জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ ছিলো এর বাচাল বুদ্ধিজীবী ও আউটডেটেড কালচারাল উইং না থাকায়। বিএনপি কখনো বিভাজন আর বিদ্বেষের সওদা করেনি। আওয়ামী লীগের বাচাল সুভাষ সিংহ আর বিএনপির মিতভাষী মারুফ কামাল খানের বাক সক্রিয়তায় যে পার্থক্য; সেটা বিএনপিকে শ্রেয়তর করেছে। আওয়ামী লীগের ফাঁপা আরাফাত আর বিএনপির পাঠ-পঠনে সমৃদ্ধ আজিজুল বারী হেলাল দলদুটির সাংস্কৃতিক ব্যবধান স্পষ্ট করে।

কাজেই আওয়ামী লীগের প্লে বুক ও অভিধান ব্যবহার করে বিএনপির নতুন বুদ্ধিজীবীরা যে বিদ্বেষের কারবার সূচিত করেছে; তা দলটির এতোদিনের ইমেজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

আওয়ামী লীগের রাজনীতির সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি, এর খারিজি প্রথা। ভিন্নমতের সবাইকে খারিজ করতে করতে আজ নিজেই খারিজ হয়ে গেছে তারা।

৫ অগাস্টের পর দৃশ্যমান বিএনপির রাজনীতিতে জুলাই বিপ্লবীদের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিকে খারিজ করার যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে; তা বিএনপির মুখে লীগের বুলির মতো শোনাচ্ছে। 

কখনো নতুনকে খারিজ করতে নেই। বৃক্ষের নিয়ম পুরোনো পাতা ঝরে যাওয়া; নতুন পাতার আগমন। এইদেশে বৃটিশ কোলাবরেটর জমিদারেরা কৃষক প্রজা আন্দোলনের তরুণদের খারিজ করে নিজেরা খারিজ হয়ে গেছে।  পাকিস্তানের কোলাবরেটর মুসলিম লীগ আওয়ামী লীগের তরুণদের খারিজ করে নিজেরাই খারিজ হয়ে গেছে। ভারতের কোলাবরেটর আওয়ামী লীগ জুলাই-এর তরুণদের খারিজ করে নিজেরাই খারিজ হয়ে গেছে।

রাজনীতির পথে যে নবীন, পদে পদে তার ভুল ধরে প্রবীণের কোনো সুকৃতি তৈরি হয় না। স্বাধীন বাংলাদেশ ৫৪ বছরে কল্যাণরাষ্ট্র হতে না পারার দায় প্রবীণদের। প্রায় ব্যর্থ সমাজের অধিপতি সেজে অহং কার দেখানোর কিছুই নেই। বরং প্রবীণদের আত্ম অনুসন্ধান প্রয়োজন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রবীণ প্রজন্মের যে আত্মকেন্দ্রিক অর্জন তা কেন সামষ্টিক অর্জন হলো না; সে প্রশ্নের উত্তর তো তাদের দিতে হবে। আপনার এই বাড়ি গাড়ি ভুড়ি কোত্থেকে এলো; ঢাকায় এসেছিলেন তো মাত্র ৩৫ টাকা নিয়ে। আপনার ছেলে-মেয়ে পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লো, কার টাকায়? আর বাংলাদেশের দারিদ্র্যে বিশীর্ণ শিশুদের জন্য কোনো শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়ে উঠলো না! আপনারা কি সচেতনভাবে এদের প্রজা করে রাখতে চেয়েছেন; যাতে আপনাদের বিলেত ফেরত ছেলেমেয়েরা এসে রাজনীতির নামে গড়ে তোলা জমিদারিতে ছড়ি ঘুরাতে পারে! কথায় কথায় বৃটিশ-এর রেখে যাওয়া প্রশাসনিক ব্যবস্থা বলে সলিম বুঝ যে দেন, সমকালের বৃটেনের সরকারি কর্মকর্তাদের আপনার মতো বেগম পাড়ায় প্রাসাদ নেই কেন! ভালোই পেয়েছেন বাংলাদেশটাকে; মানুষের রক্ত পিষে ডলার বের করে তা পাচার করে দেন ক্যানাডা, দুবাই, ভারতে। লজ্জা করে না, জুলাই তরুণদের ছিদ্রান্বেষণ করতে?

লজিং মাস্টার হয়ে গ্রাজুয়েশন করে দেশ লুট করে ভদ্রলোক সেজেছেন; ছেলে-মেয়ে জোড়াসাঁকোর পোশাক কিংবা জিনস টি-শার্ট পরে বিরাট সব প্রগতিশীল আধুনিক হয়েছে। ঠোঁট উলটে জুলাই বিপ্লবীদের ইসলামপন্থী বলতে লজ্জা লাগে না! লজিং মাস্টারের ছেলে মেয়ের অমন ছায়ানট করে জাতে উঠতে হয়। একবিংশের জেন-জি'র ওসব ভং প্রয়োজন হয় না। তাদের পৃথিবীটা ঢাকা-টু-কলকাতা সিটিং সার্ভিস নয়। ইন্টারনেটের জানালায় তাদের কাছে উন্মুক্ত উত্তর-দক্ষিণ -পূর্ব-পশ্চিম-এর সংস্কৃতি। প্যারিস থেকে বার্লিন, ইস্তাম্বুল থেকে দুবাই, কুয়ালালামপুর থেকে ব্যাংকক; কোথাও এতো মাপামাপি নাই; আর দ্বিতীয় প্রজন্মে সবুজ লুঙ্গি-খসখসে ধুতি খুলে নক্সী পাঞ্জাবি-টিশার্ট পরা জগলুল ও জগন্নাথের ছেলেমেয়ে সহমত, শিবব্রত, ললিতা, আনারকলি এসে দিনমান তরুণদের সাংস্কৃতি সনদ বিতরণ করে। রেললাইনের ধারে প্রাতঃক্রিয়া সারা জব্বার-ধনঞ্জয়ের ছেলে-মেয়ে হাইকমোডে বসে কইয়া দিলেই হলো, অরা তো রাইট উইঙ্গার। দাদার কপালে নামাজ পড়ার কালো দাগ, চন্দন চর্চিত; আর নাতি-নাতনি এসে বিরাট লিবেরেল সেজে দিনমান জ্ঞান দেয়।

হাসিনার পনেরো বছর মুখে কুলুপ এঁটে ৫ অগাস্টের পর মুখে খই ফুটেছে। হাসিনা পড়ে যাবে জেনেই আলতো করে বিজয় মিছিলে নেমে; এখন সেই একই আওয়ামী প্লে বুক থেকে মোদি প্রগতিশীলতার গান গাইতে এসেছে।

এই অপ্রিয় কথাগুলো লিখতেই হলো; কারণ কেউ লিখবে না বলে; আয়নায় কখনো মুখ দেখা হবে না এদের। এরা রয়ে যাবে ঊনবিংশ শতকের জাত-পাতের কুঁচকুঁচানি আদি মানব-মানবী হয়ে।

লেখা: মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও লেখক


মন্তব্য


সর্বশেষ সংবাদ


আরও পড়ুন


‌‘ধর্ষক’ এর জবানবন্দি!
‌‘ধর্ষক’ এর জবানবন্দি!

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৫ | ০৪:২৩