‘ধর্ষক’ এর জবানবন্দি!

ধর্ষণ হলো এক ধরনের যৌন নির্যাতন। যার মধ্যে যৌন মিলন বা যৌন অনুপ্রবেশের অন্যান্য রূপ জড়িত, যা কোনো ব্যক্তির সম্মতি ছাড়াই তার বিরুদ্ধে করা হয়। ধর্ষণ শব্দটি কখনও কখনও যৌন নির্যাতন শব্দটির সঙ্গে বিনিময়যোগ্যভাবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে বর্তমানে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। তবে আমাদের দেশে বর্তমানে ধর্ষণের চেয়ে তার অপবাদ দেওয়াটাই যেন মানুষ বেশি ব্যবহার করছে। সম্পর্কে বিচ্ছেদ হলেই ধর্ষণের অভিযোগ বা অপবাদ দেওয়া হয়। আবার ধর্ষণ না করেও মিথ্যা মামলা বা হয়রানির শিকার হতে হয়। বিশেষ করে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার আমলে শত্রুতা করে ধর্ষণের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর প্রচলন ছিল ব্যাপক হারে। তেমনই একজন ভুক্তভোগী ডা. মাকামে মাহমুদ। ছাত্রজীবনে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেলে পড়ার সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের আক্রোশের শিকার এই চিকিৎসক তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ইতিহাসের স্মৃতিচারণ করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বুধবার এ নিয়ে দীর্ঘ একটি পোস্ট দিয়েছেন ডা. মাকামে মাহমুদ। তিনি এর শিরোনাম দিয়েছেন- ‘তৌহিদ ভাই হত্যাকাণ্ড, আমার প্রতিবাদ ও আমার ওপর জুলুম-আমার জবানবন্দি’। পাঠকদের উদ্দেশে তার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
‘‘২০১৩ সাল। ভর্তি হলাম স্বপ্নের মেডিকেল কলেজ- সিলেট এম এ জি ওসমানীতে, ৫১তম ব্যাচ। এলাকার দুজন বড় ভাই ৪৯ ব্যাচে। একজন তাবলীগ (রমজান ভাই), আরেকজন ছাত্রলীগ (নাম বললাম না)। তাবলীগের আলাদা কোনো রুম বরাদ্দ ছিল না। ছাত্রলীগ দয়া করে তাদের রুমে তাবলীগ (ওদের ভাষায়-মুরগি) গুলোকে থাকতে দিতো। বিনিময়ে তাদের দাসত্ব করা লাগতো। রমজান ভাইয়ের রুমে জায়গা না থাকায় এলাকার ছাত্রলীগ ভাইয়ের রুমে উঠলাম। যাই হোক, রমজান ভাই মাটির মানুষ, সবার প্রিয় মুখ। তিল তিল করে আমাকে ইসলামিক অনুশাসন শেখাতেন। কিন্তু শিক্ষক আর ছাত্রের রক্ত যে সেইম হবে এমন তো নয়। উনার রক্ত হিম শীতল কিন্তু আমার রক্তে প্রতিবাদ। র্যাগিং, মারধর, জোরপূর্বক সালাম দেয়ানো, মিটিং মিছিলে নেওয়া। সিনিয়র টয়লেটে ঢুকছে বা বের হচ্ছে- এই অবস্থায়ও সালাম দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। ক্যাম্পাস হলগুলোতে কীভাবে র্যাগ দেওয়া হয় আপনারা তো জানেনই। সবই করতাম তাদের কথা মতো।
তবে ওদের চক্ষুশূল হলাম সৌমিত্র ইস্যু নিয়ে। তাবলীগের ছেলেদেরকে নিয়ে মন্দিরে বসিয়ে রাখতো। হ্যাঁ ঠিকই বলছি। অনেক আগে (সম্ভবত ১৯৯৮ সাল) ছাত্রলীগ খুন করেছিল শিবিরের এক ছাত্রকে। প্রতিশোধ হিসেবে সৌমিত্র দা খুন হয়েছিল শিবিরের হাতে। প্রতিবছর সৌমিত্র দার মৃত্যু বার্ষিকীতে শিবির বাদে হলের প্রত্যেক ছাত্রকে মন্দিরে যেতে হতো। আমি একবারও যাইনি। প্রথমবার অসুস্থতার দোহাই দিয়েছি, কিন্তু পরের বছর থেকে শুরু হলো টর্চার। আমি হাঁটার সময় কীভাবে পা ফেলছি, তাতেও তাদের সমস্যা।
২০১৪ সালে ছাত্রলীগ ঠিক আবরার ফাহাদ স্টাইলে পিটিয়ে হত্যা করলো ৪৯ ব্যাচের তৌহিদ ভাইকে। তৌহিদ ভাইয়ের অপরাধ ছিল সে ছাত্রদলের নেতা ছিল।বেশকিছুদিন ক্যাম্পাস ঠান্ডা থাকলো। আমার উপর অত্যাচার কমে গেলো ভাবলাম। এদিকে পড়াশুনা কিংবা ধর্মীয় বিষয়ে শিবিরের রুমে যাতায়াত বাড়লো আমার। ব্যাচের ছাত্রলীগগুলো সিনিয়রদের কাছে পিন মারা শুরু করলো। শিবির বলে ট্যাগিং শুরু করলে একদিন তর্ক লেগে যায়। তর্কের ফাঁকে বলে ফেলি - ‘ছাত্রলীগ ধইঞ্চা, যারা ডাক্তার খুন করে তারা ধইঞ্চা।’ (তৌহিদ ভাইয়ের খুনের রেফারেন্সে বলেছি)।
পরেরদিনই আমার রুমের দরজায় উপর্যুপরি লাথি। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সেই টর্চার সেলে। ‘দয়া করে রুমে থাকতে দিয়েছি, আমাদেরকেই বলিস ধইঞ্চা, তোর হলে থাকার অধিকার নেই।’ ফেসবুকে ভারত বিরোধী লেখালেখির কারণেও মারধর করা হয়, মেরে স্ট্যাম্প ভেঙে ফেলে, বিড়ি টেনে আমার মুখে ধোঁয়া মারা হয়, দাড়ি কেটে দিতে চায়। তারা বলে- ‘তৌহিদের বাবা মা তো লাশ পাইছে, তোর লাশও খুঁজে পাবে না কেউ।’ ভাবলাম তৌহিদ ভাইয়ের পরিণতি বরণ করতে হবে আমাকে। মারধরের এক পর্যায়ে তাদের পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে জীবন রক্ষা করলাম। কিন্তু এরপর থেকে ব্যাচমেটরাও রুমে ডেকে র্যাগ দেওয়া শুরু করলো। এমনকি ব্যাচের পোস্টেড ছাত্রলীগকেও সালাম দেয়া লাগতো আমার। ওরা রুমে নেশা করে ঘুমাতো আর আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক প্রক্সি দেওয়াতো। জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে পড়ল।
বহু কষ্টে প্রথমবারেই ভালো নম্বর পেয়ে এমবিবিএস শেষ করলাম। তারপর তাবলীগের চিল্লায় গেলাম। সবাই জয়েন করার একমাস পর শুরু করলাম ইন্টার্নশিপ। আমাকে কোনো গ্রুপেই ঢুকতে দিচ্ছিল না ছাত্রলীগগুলো। এরপর স্যারদের অনুরোধ করে ব্যাচের নেতাদের বিরুদ্ধে গিয়েই ঢুকলাম একটা গ্রুপে। কিন্তু অন্যদের তুলনায় কাজের চাপ বেশি দেওয়া হলো। অতিরিক্ত চাপ হলেও জীবনে কোনো রোগীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি। অসহায় রোগীদের জন্য বেশিই আন্তরিকতা দেখাতাম। এমনই এক রোগীর এটেনডেন্ট, যাকে আমি এর আগে দেখিও নাই, স্পর্শ তো দূরে থাকুক, আউট অব নো হোয়ার আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে।
ই এন টি ওয়ার্ডে রোগী ভর্তির কোনো নির্দিষ্ট ডেট থাকে না। ২৪/৭ রোগী ভর্তি হয়। ওসমানী মেডিকেলে রোগীর চাপও থাকে প্রচুর। কর্মচারী, নার্স সবাই এক্টিভ থাকে। এমন ব্যস্ত একটা ওয়ার্ডে কীভাবে একটা মেয়েকে একা একটা ছেলে রেপ করতে পারে প্র্যাকটিক্যালি ভেবে দেখেন তো। (পরে জানতে পারি- এই মেয়ে ও তার বাবা এমন নারী ঘটিত ব্যাপারে মানুষকে ট্র্যাপ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তার বাবা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য। তারা ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় এই নোংরা নাটক সাজিয়েছে)। এরপর ছাত্রলীগের একজন নেতা প্রকাশ্যে আমাকে বলেছে- ‘কিলা লাগের রে বা?’
ডিউটি চলছে, ওয়ার্ড বয় আমার সঙ্গে দাঁড়ানো। হঠাৎ এই মেয়ের বাবা এসে আমাকে গালিগালাজ শুরু করে। মেয়েটি ওখানে সবার সামনেই স্বাভাবিক দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েকে আমার সামনে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলে- এই ডাক্তার আমার সঙ্গে খারাপ কাজ করেছে। সঙ্গে সঙ্গেই কষে এক থাপ্পড় মারি সবার সামনেই (কোর্টের রায়ের জবানবন্দিতে মারধরের বিষয়টি স্বীকার করেছে)। জেদের বশে, টাকা খেতে না পেরে নোংরা মামলা দেয়, মিডিয়া ট্রায়াল করায়। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় আমি এই মেয়ের বাবাকে হুমকি দিচ্ছি। একজন স্থানীয় আওয়ামী লীগকে আমি কীভাবে হুমকি দেই? কী ক্ষমতা ছিল আমার? আমি কনফিডেন্ট ছিলাম বিধায় আপোষ করিনি। টাকা দিলে তো মামলাই হতো না।
অবশেষে সকল তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদে তারা কোর্টের কাছে পরাস্ত হয়। কোর্ট আমাকে নিরপরাধ হিসেবে বেকসুর খালাস দেয়। মেডিকেল কর্তৃপক্ষ ও তদন্ত কমিটি আমাকে NOC দেয়। অতঃপর ময়মনসিংহ মেডিকেল কর্তৃপক্ষ যাবতীয় কাগজপত্র দেখে আমাকে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ দেয়। ইন্টার্নশিপ শেষ করে স্থায়ী রেজিস্ট্রেশন পাই। A-116935 (বিএমডিসি), সার্চ করলেও ছবিসহ চলে আসবে।
একটা মিথ্যা মামলা আমার এবং আমার পরিবারকে তছনছ করে দিয়েছে। এই ট্রমা থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে অনেক সময় লেগেছে আমার। এখন এতদিন পর আবার যারা ট্রমায় ফেলতে চাচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্য কি? এনসিপি?
যারা আদালতের রায়কে অসম্মান করে আমাকে এখনও বুলিং করছেন, তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নিবো শিগগিরই।
এসব প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে আমাকে থামিয়ে রাখা যাবে না। আজীবন ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শপথ গ্রহণ করেছি। আবু সাইদের আগে আমি আবরার ফাহাদের যোদ্ধা। শুধু ক্যাম্পাসের বৈষম্য নয়, যেকোনো বৈষম্য ও স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে এই কণ্ঠে আকাশ প্রকম্পিত হবে, যতক্ষণ শ্বাস থাকে এই কন্ঠে। ইন-শা-আল্লাহ।’’
মন্তব্য
সর্বশেষ সংবাদ
আরও পড়ুন

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৫ | ০৮:৫৪

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৫ | ০৪:১৯

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৫ | ০২:৫৬

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৫ | ০৩:১১

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৫ | ০৮:০০

প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৫ | ০৭:০০